থার্টি-ফাস্ট নাইট সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?
সূচিপত্র
- থার্টি-ফাস্ট নাইট সম্পর্কে ইসলাম কি বলে
- থার্টি-ফাস্ট নাইটের উৎপত্তি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
- ইসলাম ধর্মে সময় ও কালের মূল্য
- নববর্ষ উদযাপন ও ইসলামী ঐতিহ্য
- পশ্চিমা সংস্কৃতি বনাম ইসলামী সংস্কৃতি
- থার্টি-ফাস্ট নাইটের অপসংস্কৃতি ও সমাজের প্রভাব
- ইসলামে অনুকরণ ও তার বিধান
- তরুণ সমাজের জন্য শিক্ষা
- ইসলাম সম্মত বিকল্প ও ইতিবাচক আয়োজন
- আত্মসমালোচনা ও নতুন বছরের পরিকল্পনা
- উপসংহার: মুসলমানের করণীয়
থার্টি-ফাস্ট নাইট সম্পর্কে ইসলাম কি বলে
থার্টি-ফাস্ট নাইটের উৎপত্তি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
থার্টি-ফাস্ট বা ৩১ ডিসেম্বরের রাত মূলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের শেষ রাত। ইউরোপে খ্রিস্টান সমাজ নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান করত, যা ধীরে ধীরে বিনোদননির্ভর সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। নাচ-গান, আতশবাজি, পার্টি ও বিভিন্ন রকম ভোগবিলাস এই রাতকে একটি বিশেষ রূপ দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এই প্রথা মুসলিম দেশগুলোতেও প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশসহ বহু দেশে তরুণ সমাজ রাত্রিবেলায় সড়কে আড্ডা, কনসার্ট, ক্লাব বা উন্মুক্ত স্থানে হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটায়। যদিও অনেকেই এটিকে ‘আধুনিকতা’ ও ‘মজা’ মনে করে, তবে এর পেছনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ধর্মীয় নয় বরং সাংস্কৃতিক এবং ভোগবাদী। ইসলাম এসব বিষয়কে কিভাবে দেখে, সেটিই আমাদের আলোচনার মূল বিষয়।
ইসলাম ধর্মে সময় ও কালের মূল্য
ইসলামে সময়কে আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কোরআনে আল্লাহ কসম করেছেন "আসর" এর (সময়) এর নামে (সূরা আসর), যা প্রমাণ করে সময়ের মর্যাদা কত উচ্চ। রাসূলﷺ বলেছেন "দুই নিয়ামত আছে, যাকে অনেক মানুষ অবহেলা করে: স্বাস্থ্য ও অবসর সময় "(বুখারি)। অর্থাৎ মুসলমানের জীবনে সময় কাটানোর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ইবাদত, সৎকর্ম ও মানবতার কল্যাণে।
অথচ থার্টি-ফাস্ট নাইটে যে অযথা সময় অপচয়, অশ্লীলতা বা অর্থব্যয় হয়, তা ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। নতুন বছর শুরু করা খারাপ নয়, তবে সেটিকে উদযাপন করতে গিয়ে যদি আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরে যাওয়া হয়, তাহলে সেটি গোনাহের মধ্যে পড়বে। ইসলাম চায় মানুষ যেন তার অতীতকে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে দেখে এবং ভবিষ্যতের জন্য নেক আমল করার পরিকল্পনা করে।
নববর্ষ উদযাপন ও ইসলামী ঐতিহ্য
ইসলামে নিজস্ব ক্যালেন্ডার রয়েছে, যা হিজরি সনের ভিত্তিতে। রাসূলﷺ এর হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি বর্ষ গণনা শুরু হয়। মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো রমজান, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, আশুরা ইত্যাদি। কিন্তু গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উদযাপন ইসলামের মৌলিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নববর্ষকে কেন্দ্র করে আনন্দ করা নিষিদ্ধ নয়, তবে তা হতে হবে সীমার মধ্যে এবং ইসলাম সম্মত উপায়ে।
রাসূলﷺ বলেছেন- "যে জাতির সাথে মিল রাখবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে "(আবু দাউদ)। তাই মুসলমান যদি নববর্ষ উদযাপনে এমনভাবে অংশ নেয় যে তা খ্রিস্টান বা পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা ইসলামী দৃষ্টিতে সমর্থনযোগ্য নয়। বরং মুসলমানের জন্য নববর্ষ হতে পারে আত্মশুদ্ধি ও দোয়ার রাত, যেখানে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও নতুন বছরের পরিকল্পনা করা যায়।
পশ্চিমা সংস্কৃতি বনাম ইসলামী সংস্কৃতি
বর্তমান বিশ্বে গ্লোবালাইজেশনের কারণে পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রায় প্রতিটি সমাজে প্রবেশ করেছে। থার্টি-ফাস্ট নাইট মূলত পশ্চিমা ধাঁচের আনন্দ-উল্লাসের প্রতিফলন। মুসলিম সমাজে যদি পশ্চিমা সংস্কৃতির এসব অনুষ্ঠান অনুকরণ করা হয়, তবে তা ধীরে ধীরে ইসলামী মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পশ্চিমা উৎসবগুলোতে মদ্যপান, নাচ-গান, অশ্লীলতা সাধারণ বিষয়, অথচ ইসলাম এসবকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
ইসলাম শালীনতা, সংযম, দোয়া, দান এবং ইবাদতের শিক্ষা দেয়। তাই একজন মুসলমানের দায়িত্ব হলো অন্ধ অনুকরণ না করে নিজের মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরা। থার্টি-ফাস্ট নাইট ইসলামকে বাদ দিয়ে শুধু বিনোদনের অজুহাত হয়ে উঠলে তা আমাদের ঈমানি জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
থার্টি-ফাস্ট নাইটের অপসংস্কৃতি ও সমাজের প্রভাব
বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিম সমাজে থার্টি-ফাস্ট নাইটে অশ্লীলতা, বেপরোয়া মোটরসাইকেল রেস, উন্মুক্ত স্থানে অযথা হৈ-চৈ, মাদক সেবন, হয়রানি ও দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। মিডিয়ায় প্রতিবছর দেখা যায়, এই রাতে অসংখ্য দুর্ঘটনা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটে। ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সামাজিক জীবনেও শৃঙ্খলা চায়। রাসূলﷺ বলেছেন "মুমিন সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে "(বুখারি, মুসলিম)।
অথচ থার্টি-ফাস্ট নাইটে অনেকেই এমন আচরণ করে, যাতে অন্যরা অশান্তি, ভয় ও ক্ষতির শিকার হয়। ফলে এটি সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ডেকে আনে এবং ইসলামী জীবনবোধের পরিপন্থী হয়ে ওঠে। মুসলমানের উচিত এসব অপসংস্কৃতি বর্জন করে শান্তিপূর্ণ ও আল্লাহভীরু জীবনধারা বেছে নেওয়া।
ইসলামে অনুকরণ ও তার বিধান
রাসূলﷺ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য ধারণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে (আবু দাউদ, মুসনাদ আহমদ)। অর্থাৎ মুসলমান যদি অন্য জাতির ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক রীতি অনুসরণ করে, তাহলে তা ঈমানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। থার্টি-ফাস্ট নাইট উদযাপন পশ্চিমা সমাজের একটি সংস্কৃতি, যা মূলত তাদের আনন্দ-উল্লাস ও ভোগবাদকে কেন্দ্র করে। ইসলাম চায় মুসলমানরা তাদের নিজস্ব পরিচয়, মর্যাদা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করুক। তাই একজন মুসলিম যদি স্রেফ বিনোদনের জন্য হলেও পশ্চিমা কায়দায় নববর্ষ উদযাপন করে, তবে সেটি ধীরে ধীরে তার অন্তরে অন্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামে অনুকরণের নিষেধাজ্ঞা মূলত মুসলিম উম্মাহকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই।
তরুণ সমাজের জন্য শিক্ষা
থার্টি-ফাস্ট নাইট সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তরুণ সমাজের কাছে। তারা এই রাতকে ‘এডভেঞ্চার’ বা ‘ফান’ হিসেবে দেখে। কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিতে যুবক-যুবতী হলো সমাজের ভবিষ্যৎ নেতা। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন তুমি যুবকদের মাধ্যমে আমার দ্বীনকে শক্তিশালী করো (আল-কাহফ সূরা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়)। নবীﷺ বলেছেন, সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে, তার মধ্যে একজন হলো সেই যুবক, যে তার যৌবন আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছে।
অথচ বাস্তবতায় দেখা যায়, আমাদের তরুণরা এই রাতে সময় অপচয় করছে, নেশা করছে, বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে বা অশ্লীলতায় জড়াচ্ছে। ইসলাম তাদের প্রতি আহ্বান জানায়—তারা যেন নিজেদের শক্তি ও উদ্যম সৎ কাজে ব্যবহার করে, যেমন: ইলম অর্জন, দাওয়াহ, খেলাধুলা বা সমাজসেবায়।
ইসলামসম্মত বিকল্প ও ইতিবাচক আয়োজন
থার্টি-ফাস্ট নাইট নিয়ে শুধু নিষেধাজ্ঞার কথাই নয়, বরং মুসলমানের জন্য বিকল্প পথও আছে। কেউ যদি বছরের শেষ রাতে বিশেষ কিছু করতে চায়, তবে সেটিকে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো যেতে পারে। যেমন: নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, অতীতের গোনাহ মাফ চাইতে দোয়া, পরিবারকে নিয়ে ইসলামী আলোচনা ইত্যাদি। অনেক ইসলামিক সংগঠন এদিন সেমিনার, কুইজ প্রতিযোগিতা, দোয়া মাহফিল বা সামাজিক সেবামূলক কর্মসূচি আয়োজন করে।
এগুলো তরুণদের জন্য আনন্দদায়কও হতে পারে এবং একইসাথে ঈমান শক্তিশালী করার মাধ্যমও হয়। ইসলাম বিনোদনকে নিষিদ্ধ করেনি, বরং সীমার মধ্যে থেকে ইতিবাচক বিনোদনকে উৎসাহিত করেছে। তাই মুসলমানের জন্য উত্তম বিকল্প হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করা।
আত্মসমালোচনা ও নতুন বছরের পরিকল্পনা
ইসলামের শিক্ষায় নতুন বছর মানে হলো আল্লাহ প্রদত্ত সময়ের নতুন অধ্যায়। রাসূলﷺ এর সাহাবারা প্রতিটি নতুন বছর বা নতুন মাস শুরুতে নিজেদের আমল নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। মুসলমানের জন্য নতুন বছরের প্রথম কাজ হওয়া উচিত আত্মসমালোচনা গত বছরে আমি কতটা ভালো কাজ করেছি, কতটা খারাপ কাজ করেছি, কোথায় উন্নতি করা দরকার।
এরপর পরিকল্পনা করা দরকার, যাতে নতুন বছর আরও ইবাদতময় ও কল্যাণকর হয়। যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করার অঙ্গীকার, সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন, পাপ থেকে দূরে থাকা, জ্ঞান অর্জন করা, আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনের চেষ্টা ইত্যাদি। থার্টি-ফাস্ট নাইটের আনন্দের বদলে যদি মুসলিম তার জীবনকে নতুন পরিকল্পনায় সাজায়, তবে তা তার ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
উপসংহার: মুসলমানের করণীয়
থার্টি-ফাস্ট নাইটের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান স্পষ্ট এটি মুসলমানের জীবনধারা নয়। ইসলাম সময়কে গুরুত্ব দেয়, বিনোদনকে সীমার মধ্যে অনুমতি দেয়, তবে অশ্লীলতা, ভোগবাদ ও অন্ধ অনুকরণকে কখনোই সমর্থন করে না। একজন মুসলমানের উচিত, পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ না করে নিজের কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক পরিচয় রক্ষা করা।
নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর সর্বোত্তম উপায় হলো দোয়া, ইবাদত, দান-খয়রাত এবং নতুন বছরের জন্য নেক পরিকল্পনা করা। মুসলিম সমাজ যদি থার্টি-ফাস্ট নাইটের অপসংস্কৃতি ত্যাগ করে ইসলাম সম্মত বিকল্প গ্রহণ করে, তবে তরুণ প্রজন্ম সঠিক পথে অগ্রসর হবে, সমাজে নৈতিকতা বাড়বে এবং আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।
ট্রিকি ইমনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url